জেএন ২৪ নিউজ ডেস্ক: সাত মাস ধরে শিশু রিয়াদুস সালেহীন হামদানকে লালন-পালন করেন এক নারী। এই সময়ে মা আর সন্তানের মধ্যে অকৃত্রিম বন্ধন তৈরি হয়েছে। এই পালিত মায়ের কোল থেকে বিদায় হয়ে গর্ভধাারিনী মায়ের কোলে নেওয়ার সময় কেঁদে ওঠে অবুঝ হামদান। তার সঙ্গে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন পালিত মা। বললেন, ‘বাবা তুই যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস।’
সোমবার দুপুরে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপারের (এসপি) কার্যালয়ে এই দৃশ্যের অবতরণা হয়। এসপি আসাদুজ্জামান বলেন, দীর্ঘ সাত মাস পর শিশু রিয়াদুস সালেহীন ওরফে হামদান খুঁজে পেয়েছে তার হারানো জন্মদাতা মা-বাবাকে। মূলত অন্যের সন্তানকে তার বাবা-মার কাছ থেকে পালক আনেন ওই মা। স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে ভাগ নেওয়ার জন্য এক নার্সের সহযোগিতায় তিনি এ কাজ করেছেন। তিনি হামদানকে নিজের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন তার স্বামীর কাছে।
সংবাদ সম্মেলনে আসাদুজ্জামান বলেন, ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর এইচ এম দেলোয়ার হোসেনের প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি এক বিধবা নারীকে ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকে ওই নারী তার মায়ের বাড়ি যাতায়াত করতেন। আর বিয়ের তিন মাস পরে ওই নারী গর্ভবতী হন। তিনি তার স্বামী দেলোয়ারকে জানান যে, তিনি গর্ভবর্তী হয়েছেন। পরে ওই নারীর গর্ভের সন্তান ২০২২ সালের ৪ নভেম্বর একটি মৃত সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু তিনি তার স্বামীকে জানান, তিনি একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। ওই শিশুর নাম রাখা হয় রিয়াদুস সালেহীন ওরফে হামদান।
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকার এসপি বলেন, পরে ওই নারী রিয়াদুস সালেহীন ওরফে হামদানকে নিয়ে ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর তার স্বামীর বাড়ি সাভার থানার তালবাগে ফিরে আসেন।
আসাদুজ্জামান বলেন, মূলত ওই নারী তার স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে ভাগ নেওয়ার জন্য অপরের সন্তানকে তার স্বামীর ঔরসজাত সন্তান হিসেবে পরিচিত করেন। তাদের সন্তান রিয়াদুস সালেহীন ওরফে হামদান একটু বড় হলে তার চেহারা লক্ষ্য করে দেলোয়ারের মনে সন্দেহ হয় যে, সন্তান তার ঔরশের সন্তান নয়। একপর্যায়ে দেলোয়ার তার স্ত্রীকে নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ওই নারী স্বীকার করেন যে, শিশু রিয়াদুস সালেহীন ওরফে হামদান তার গর্ভের সন্তান নয়। আর তিনি ওই শিশুটিকে কৌশলে নঁওগা জেলার মহাদেবপুর থানা এলাকা থেকে এনেছেন।
ঘটনার বিষয়টি ওই নারীর স্বামী জানতে পেরে চলতি বছরের গত ১২ মে স্ত্রীকে তালাক দেন। পরে বিষয়টি সাভার মডেল থানায় হাজির হয়ে মৌখিক অভিযোগ করেন সন্তান দিয়ে দেওয়া মা। পরে সাভার থানার থানার একদল চৌকশ অফিসার বিষয়টি সরেজমিনে অনুসন্ধান করে। একপর্যায়ে ওই নারীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে জানতে পারে যে, ওই শিশুটির আসল বাবা-মা বগুড়ার শান্তাহার উপজেলা এলাকায় বসবাস করছে।
বিষয়টি আরো গভীরভাবে অনুসন্ধান ও তদন্ত করে তথ্যপ্রযুক্তি, স্থানীয় লোকজন এবং বগুড়া জেলা পুলিশের সহায়তায় সাভার মডেল থানা পুলিশ শিশুটির আসল বাবা-মার সন্ধান পায়। শিশুটির আসল বাবা-মাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানায় যে, তাহারা হতদরিদ্র, অসচ্ছল ও অসহায় বিধায় ওই শিশুটির নিখোঁজের বিষয়ে কোনো খোঁজ খবর নিতে পারেনি। এছাড়াও শিশুটির মা অসুস্থ থাকায় কোনো প্রকার আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেনি। পরবর্তীতে শিশুটির প্রকৃত বাবা-মাকে সাভার মডেল থানায় এনে বিস্তারিত জানতে পারে পুলিশ।
হামদানের বিষয়ে কোনো মামলা হয়েছে কী না এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকার এসপি বলেন, ‘না এখনও এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।’
পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে আনা হয় হামদানের প্রকৃত বাবা-মা ও পালক মাকে। হামদানের প্রকৃত মায়ের ভাষ্য, হামদানের যখন জন্ম হয় তখন তিনি হৃদরোগসহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। তখন ওই শিশুকে লালন পালন করার সক্ষমতা তার ছিল না। আর হামদানের পালিত মা বলেছিলেন তিনি হামদানকে যত্নসহকারে লালন পালন করবেন। তাকে কোরআনের হাফেজ বানাবেন। তাই তারা সন্তানকে পালন করতে দিয়েছেন। তিনি সন্তানের বিনিময়ে কোনো টাকা পয়সা নেয়নি। আর যারা হামদানকে তার মা থেকে নিয়ে এসেছেন তারাও চুরি করে নেননি।
হামদানের বাবা বলেন, হামদানকে পালন করতে দেওয়ার পরে সৌদি আরবে তার এক ছেলে দুর্ঘটনায় আহত হয়। সেখানে প্রায় ছয় লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। পরে আমি আমার ছেলে হামদানকে ফিরে পেতে ব্যকুল হই। তবে হামদানের পালিত মার প্রতি তাদের কোনো অভিযোগ নেই।
হামদানের পালিত মার বক্তব্য হচ্ছে, তিনি নওগাঁয়ের একটি ক্লিনিকের এক নার্সের মাধ্যমে হামদানের বাবা-মার সন্ধান পান। তাদের নানা ধরনের সমস্যার কথা শুনে তিনি হামদানকে পালক নেওয়ার প্রস্তাব দেন। তখন তার প্রস্তাবে সাড়া দেন হামদানের বাবা-মা। পরে মানবিক কারণে হামদানের মার সিজারের (অস্ত্রপচারের) খরচ দেন, ওষুধ কিনে দেন আর হাতে নগদ পাঁচ হাজার টাকা দেন পালক মা।
মধ্যস্থতাকারী নার্সকে কত টাকা দিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে ওই নারী বলেন, সেটা আমার মনে নেই। তবে সামান্য কিছু বখশিস দিয়েছি।
হামদানকে নিয়ে আপনার সংসার ভেঙেছে, ‘আপনি কি আবারও ওই সংসারে ফিরতে চান? জবাবে হামদানের পালিত মা বলেন, না তিনি (সাবেক স্বামী) আমার প্রতি এখনও অনেক রেগে আছেন। দেখা যাক কী হয়।’
হামদানকে সাত মাস ধরে লালন পালনের পর তার প্রকৃত বাবা-মা নিয়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় পালিত মা বলেন, ‘আমার খুব খারাপ লাগছে। তবে ও যেখানে থাকুক ভালো থাকবে, এটাই আমার একমাত্র প্রত্যশা।’
Leave a Reply