জেএন ২৪ নিউজ ডেস্ক: সাত বছরের বেশি সময় বাদে বৃহস্পতিবার (৬ এপ্রিল) ইরান ও সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কূটনৈতিক বৈঠকে বসেছেন। চীনের মধ্যস্থতায় বৈঠকটি বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলির মধ্যে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করার চুক্তির অধীনে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে সৌদি রাষ্ট্র চালিত আল এখবারিয়া টেলিভিশন জানিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বিরোধ বেশ পুরনো। বিশেষ করে ধর্মীয় মতাদর্শ ভিন্ন হওয়ায় সৌদি-ইরান সম্পর্ক অনেকটাই সাপে নেউলে ছিল। মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বছরের পর বছর ধরে চলা শত্রুতার পর, তেহরান এবং রিয়াদ তাদের কূটনৈতিক ফাটলের সংস্কার করতে এবং দূতাবাস পুনরায় চালু করতে গত মাসে চীনের সহায়তায় একটি বড় চুক্তিতে সম্মত হয়েছে।
তেহরান এবং রিয়াদের মধ্যে অগ্রগতিতে বেইজিংয়ের গোপন ভূমিকা মধ্যপ্রাচ্যে গতিশীলতাকে শক্ত করেই নাড়া দিয়েছে। এই অঞ্চলে কয়েক দশক ধরে প্রধান মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইরান-সৌদি আরবের সম্পর্কের বেশ উত্থান-পতন ঘটেছে। এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা-
১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লব
১৯৭৯ সালে ইরানের শেষ রাজ বংশের পতন ঘটার মাধ্যমে ইরানে সম্পূর্ণ শিয়া মুসলিমদের শাসন শুরু হয়। ঘটনায় স্বভাবতই ক্ষুব্ধ হয় সুন্নি মতাদর্শে বিশ্বাসী রিয়াদ। শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির পতনের মাধ্যমে ইরানে যে বিপ্লব শুরু হয় তাকে ইতিহাসে ইরান বিপ্লব বা ইসলামী বিপ্লব হিসেবে বর্ণনা কার হয়ে থাকে। এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বিপ্লব হিসেবেও স্বীকৃত।
১৯৮০-১৯৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধ
১৯৮০-৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইরাকের প্রতি সৌদি সমর্থনের জন্য ইরানিরা উত্তেজিত। যুদ্ধে বাগদাদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে।
১৯৮৭-৮৮ সালের মক্কা সংঘর্ষ
সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে সম্পর্ক ১৯৮৭ সালের সালের জুলাই মাসে খারাপভাবে উত্তপ্ত হয় যখন ৪০২ তীর্থযাত্রী পবিত্র মক্কা নগরীতে সংঘর্ষে মারা যায়। এর মধ্যে ২৭৫ জন ছিল ইরানি। সেসময় তেহরানে বিক্ষোভকারীরা সৌদি দূতাবাস দখল করে এবং কুয়েতের দূতাবাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। দূতাবাসের জানালা থেকে পড়ে গিয়ে তেহরানে একজন সৌদি কূটনীতিক আহত হয়ে মারা যান এবং রিয়াদ তেহরানকে সৌদি আরবের একটি হাসপাতালে স্থানান্তর করতে বিলম্ব করার অভিযোগ তোলে। রাজা ফাহদ ১৯৮৮ সালে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ১৯৯১ সালে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা হয়।
১৯৯৭ সালের সম্মেলন
তৎকালীন সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স আবদুল্লাহ ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে একটি ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনের জন্য অ-আরব ইরানে সফর করেন। এটি ছিল ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে সৌদি আরবের সর্বোচ্চ পদধারীর কোনো ব্যক্তির ইরান সফর।
১৯৯৯ সালের পর সুদিন
সৌদি বাদশাহ ফাহদ ইরানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামিকে ২০০১ সালে তার নির্বাচনী বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, এটি তার সংস্কারবাদী নীতির সমর্থন। খাতামি ১৯৯৭ সালে তার প্রথম ভূমিধস জয়ের পর রিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য কাজ করেছিলেন। খাতামি সৌদি আরব সফর করেন যা ১৯৭৯ সালের পর এই ধরনের প্রথম সফর ছিল। ২০০১ সালের এপ্রিলে একটি নিরাপত্তা চুক্তির মাধ্যমে উন্নত সম্পর্ক সীলমোহর করা হয়।
২০০৩-২০১২: আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি
২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনে পতন ঘটে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের। পরবর্তীতে দেশটিতে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠদের ক্ষমতায়ন করা হয় এবং এর ফলে ইরানের দিকে রাজনৈতিক হাওয়া বইতে শুরু করে।
২০০৫ সালে সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ মিত্র লেবাননের রফিক আল-হারিরির হত্যাকাণ্ড বৈরুতে ক্ষমতার লড়াইয়ের মঞ্চ তৈরি হয়। একদিকে সিরিয়াসহ ইরান এবং তার মিত্রদের, অন্যদিকে মার্কিন-মিত্র, সুন্নি নেতৃত্বাধীন উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলো। লেবানন ক্রমশ ভারী অস্ত্রধারী ইরান-সমর্থিত লেবানিজ গ্রুপ হিজবুল্লাহর কবলে পড়ে।
প্রায় ১৫ বছর পরে, জাতিসংঘ-সমর্থিত আদালত হারিরি হত্যার জন্য অনুপস্থিতিতে তিন হিজবুল্লাহ সদস্যকে দোষী সাব্যস্ত করে। ট্রাইব্যুনালকে শত্রুদের হাতে হাতিয়ার হিসেবে বর্ণনা করে দলটি তাদের ভূমিকা অস্বীকার করে।
ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে ২০০৬ সালের যুদ্ধ সৌদির সন্দেহকে আরও শক্ত করে যে তেহরান সৌদি স্বার্থের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং তারা নতুন আঞ্চলিক জোট তৈরি করছে।
ইরানের বিতর্কিত পারমাণবিক শক্তি কর্মসূচী সৌদির ভয়কে আরও গভীর করে যে তেহরান, খাতামির কট্টর জাতীয়তাবাদী উত্তরসূরি মাহমুদ আহমাদিনেজাদ উপসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করতে আগ্রহী।
উইকিলিকসের মতে, সৌদি আরবের বাদশাহ আবদুল্লাহ ২০০৮ সালে তার নিজের কূটনীতিকদের বলেছিলেন, তিনি চান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘সাপের মাথা কেটে ফেলুক।’
২০১১ সালের আরব বসন্ত
গণতন্ত্রপন্থী বিদ্রোহ তিউনিসিয়া এবং মিসর থেকে উপসাগরে পূর্ব দিকে সরে যাওয়ায় সৌদি আরবের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। দ্বীপের শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠরা ক্ষমতা গ্রহণ করবে এবং ইরানের সঙ্গে মিত্রতা করবে এই আশঙ্কায় বাহরাইনে বিক্ষোভকে লাল রেখা হিসেবে দেখা হয়েছিল।
সৌদি সৈন্যরা বাহরাইনের সুন্নি রাজপরিবারের অনুরোধে বাহরাইনের শিয়াদের অস্থিরতা কমাতে সাহায্য করে।
সৌদি আরব তার পূর্ব প্রদেশের কিছু শিয়াদের বিরুদ্ধে পুলিশ এবং শিয়াদের মধ্যে সংঘর্ষের পর ভিন্নমতের বীজ বপন করার জন্য একটি বিদেশী রাষ্ট্র মানে ইরানকে সহযোগিতা করার অভিযোগ করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, তারা ওয়াশিংটনে সৌদি রাষ্ট্রদূতকে হত্যার ইরানী চক্রান্ত উন্মোচন করেছে। রিয়াদ বলেছিল, প্রমাণ অপ্রতিরোধ্য এবং তেহরানকে এর জন্য চড়া মূল্য দিতে হবে। ইরান তেহরান ও সৌদি আরবের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির লক্ষ্যে এই প্রতিবেদনটিকে বানোয়াট বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
২০১১ সালে সিরিয়া যুদ্ধ
মধ্যপন্থী হাসান রুহানি ২০১৩ সালের জুনে ইরানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ইরানের এ পর্যন্ত দ্বন্দ্বমূলক বৈদেশিক নীতিকে সমঝোতামূলক দিকে নিয়ে যান। ইরান তার পারমাণবিক তৎপরতা সীমিত করতে নভেম্বরে বড় শক্তির সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী চুক্তি করে। এতে ইরান এবং বেশিরভাগ উপসাগরীয় আরব প্রতিবেশীদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হয়।
সৌদি নেতৃত্বাধীন উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ ডিসেম্বরে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অ-হস্তক্ষেপ’ এর ভিত্তিতে ইরানের সঙ্গে সুসম্পর্কের আহ্বান জানায়। কিন্তু ইরান-সৌদি সম্পর্ক জমাট বাধা অবস্থাতেই রয়ে গেছে। তাদের আঞ্চলিক শক্তির লড়াই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বেশ ভালভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে। রিয়াদ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদ্রোহীদের প্রধান সমর্থক বলে অভিযোগ তোলে যে কিনা তেহরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র।
২০১৫ সালে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠী সিরিয়ার রাজধানী সানায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর সৌদি আরব হুথি আন্দোলনের বিরুদ্ধে পশ্চিমা-সমর্থিত জোটের নেতৃত্বে ইয়েমেনে হস্তক্ষেপ করে। যুদ্ধটি কয়েক বছর ধরে সামরিক অচলাবস্থায় রয়েছে।
২০১৬: সম্পর্কের অবনতি
সৌদি আরব ২০১৬ সালের ২ জানুয়ারিতে বিশিষ্ট শিয়া ধর্মগুরু নিমর আল-নিমরসহ প্রায় ৫০ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়। এতে তেহরানে বিক্ষোভকারীরা সৌদি দূতাবাসে হামলা চালায় এবং শিয়া ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি নিমরের জন্য ‘ঐশ্বরিক প্রতিশোধের’ প্রতিশ্রুতি দেন।
এরপর ৩ জানুয়ারি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সৌদি আরব।
৭ জানুয়ারি ইয়েমেনে তার দূতাবাসে বিমান হামলার জন্য সৌদি আরবকে অভিযুক্ত করে ইরান। সৌদি কর্মকর্তারা এই দাবিকে প্রোপাগান্ডা বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
২০১৬ সালের ২৯ মে সৌদি আরবকে ‘নাশকতার’ জন্য দায়ী করে এবং তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ বলে অভিযোগ করে ইরান তার তীর্থযাত্রীদের বার্ষিক হজ যাত্রায় যোগদান নিষিদ্ধ করে।
২০১৯ থেকে বর্তমান
২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর, সৌদি আরব তার তেল স্থাপনায় হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করে যার রাজ্যের সরবরাহের অর্ধেক ছিটকে যায়। তবে হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে ইরান। ইয়েমেনের ইরান সমন্বিত হুথি গোষ্ঠী হামলার দায় স্বীকার করে নেয়।
৩ জানুয়ারি, ২০২০, ইরানের সামরিক কমান্ডার কাসেম সোলেইমানি বাগদাদে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন।
৯ এপ্রিল, ২০২১, ইরান এবং সৌদি আরব বিচ্ছেদের পর তাদের প্রথম সরাসরি আলোচনার আয়োজন করে, যার আয়োজক ছিল বাগদাদ। এপ্রিল ২০২১ এবং সেপ্টেম্বর ২০২২ সালের মধ্যে চার দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বেশিরভাগই ছিল ইরাক এবং ওমানের মধ্যস্থতায়।
সৌদি আরবে গণহত্যা চালানোর একদিন পরে ইরান ১৩ মার্চ, ২০২২ সালে আলোচনা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে। কর্মীরা বলেছিলেন, ঘটনার শিকার ছিল ৪১ জন শিয়া মুসলিম।
ইরান এবং সৌদি আরব ২১ এপ্রিল, ২০২২ তারিখে পঞ্চম দফা আলোচনা শুরু করে। ১৯ অক্টোবর, ২০২২ তারিখে ইরানের খামেনির শীর্ষ উপদেষ্টা সৌদি, ইরানের দূতাবাস পুনরায় চালু করার আহ্বান জানায়। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ৯ ডিসেম্বর, ২০২২ তারিখে সৌদি আরব সফর করেন এবং ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে আলোচনা করেন।
শির সঙ্গে দেখা করতে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ তারিখে চীন সফর করেন। অবশেষে চলতি বছরের ১১ মার্চ তারিখে বছরের পর বছর ধরে শত্রুতার পর চীনের মধ্যস্থতায় সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হয়- ইরান এবং সৌদি আরব।
Leave a Reply