জেএন ২৪ নিউজ ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের পররাষ্ট্র-প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত সরকারের অবস্থান ‘স্পষ্টভাবেই’ তুলে ধরা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিশ্লেষকরা বলছেন, আমেরিকা যাতে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বেশি চাপ না দেয়, সেই বার্তাই শুক্রবারের বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছে ভারত।
শুক্রবার দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। এই বৈঠকে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসও।
বৈঠক শেষে বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। সেখানে বিনয় কোয়াত্রা জানান, দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার ক্ষেত্রে আমরা খুব স্পষ্ট ছিলাম।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমি মনে করি বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়টি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের জনগণই তাদের ভবিষ্যতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। বন্ধু ও অংশীদার হিসেবে ‘স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের লক্ষ্যকে’ ভারত সমর্থন জানাবে।
বিনয় কোয়াত্রা বলেন, বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি ভারত শ্রদ্ধাশীল। এবং স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল জাতি গড়ার যে রূপকল্প তারা ঠিক করেছে, সেক্ষেত্রে সমর্থন অব্যাহত রাখবে ভারত।
বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব কেমন ছিল? এমন প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, তৃতীয় কোনো দেশের নীতি নিয়ে মন্তব্য ভারত সমীচীন মনে করে না।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের এমন অবস্থান নতুন নয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যেভাবে নানা মন্তব্য করছে, তার বিপরীতে গিয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে মার্কিন সচিবদের সামনে তুলে ধরার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে প্রতিবারই সরব হতে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সরকারগুলোকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশের পাশাপাশি যথেষ্ট চাপও সৃষ্টি করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র কিছু দিন আগে বাংলাদেশের জন্য তাদের নতুন ভিসা নীতিও ঘোষণা করেছে।
‘বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা যাতে চাপ না দেয়’
বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে সেদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের নানা মন্তব্যের প্রেক্ষিতে শুক্রবারের বৈঠকে ভারত তাদের অবস্থান যে স্পষ্ট করে দিয়েছে, সেটাকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ী বলছেন, ‘ভারতের অবস্থান স্পষ্টই ছিল, কিন্তু সেটা ‘খুব স্পষ্ট’ করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিবের সামনে তুলে ধরাটা খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে আমাদের।’
তার কথায়, ‘ভারতের পক্ষে বাংলাদেশে একটা স্থিতিশীল সরকার থাকা খুবই জরুরি আমাদের উত্তরপূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে। সেদেশের ভোটের আগে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে শেখ হাসিনার সরকারের ওপরে নানাভাবে চাপ বাড়াচ্ছে, সেদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়েও তারা যুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে, সেগুলো তো ঘটনা। তাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যাতে তারা বেশি মাথা না ঘামায়, সেটা ভারত স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে। যদিও যৌথ বিবৃতি জারি করা হলে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানটা জানা যেত।’
ভারত কেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বন্দ্বে যাচ্ছে?
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক অনেক দৃঢ় হয়েছে। প্রতিবছর টু প্লাস টু বৈঠক যেমন করছেন দুই দেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীরা, তেমনই মার্কিন প্রেসিডেন্ট আর নরেন্দ্র মোদীর মাঝে-মধ্যেই সাক্ষাৎ হয়। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কেন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বে ভারত?
পররাষ্ট্র সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ শশাঙ্ক মাট্টু তার এক্স (আগেকার টুইটার) হ্যাণ্ডেলে পর পর বেশ কয়েকটি পোস্ট করেছেন বাংলাদেশ নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রর ভূমিকা ও ভারতের অবস্থান নিয়ে। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘ভারত কেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দ্বন্দ্বে যাচ্ছে? যুক্তরাষ্ট্রের মাথা গলানোর কারণে ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হুমকির মুখে পড়ছে।’
প্রথম এই পোস্টের সঙ্গে ভারত আর বাংলাদেশের দুই প্রধানমন্ত্রীর একটা ছবি দিয়েছেন মাট্টু। এর পরবর্তী পোস্টগুলিতে মাট্টু ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘ওয়াশিংটন প্রকাশ্যেই হাসিনা সরকারকে সুষ্ঠু নির্বাচন করার আহ্বান জানিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাসিনা সরকার আর আমেরিকার মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে মানবাধিকার ইস্যুতে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমেরিকার অবস্থান একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে।’
তিনি এও বলেছেন যে, ভারতের প্রতিবেশীদের মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ শরিক হলেন শেখ হাসিনা। তিনি যদি নির্বাচনে পরাজিত হন, তাহলে প্রতিবেশীদের নিয়ে ভারতের নীতিমালাতেও সমস্যা হবে।
বৈঠকের আগে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) বিশেষজ্ঞ রিক রসো বলেছিলেন, ভারত-মার্কিন স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ইস্যুগুলোর প্রভাবই কিন্তু বেশি থাকবে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘গাজা বা ইউক্রেনের যুদ্ধের চেয়ে বাংলাদেশ কিংবা শ্রীলঙ্কায় কী ঘটছে, সেটাই কিন্তু ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ!’
নির্দিষ্ট কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে রিক রসো বলেন, ‘যেমন ধরুন বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী আলাদা। মিয়ানমারের সামরিক জুনটার সঙ্গেও দুই দেশ আলাদাভাবে কথা বলছে।’
‘ওদিকে মালদ্বীপে একটি নতুন চীন-পন্থী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। অস্থিরতার আশঙ্কা আছে শ্রীলঙ্কা বা নেপালে। ভারতের কাছে এই ইস্যুগুলোর গুরুত্ব অনেক বেশি এবং আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও অনেক সরাসরি যুক্ত’, মন্তব্য করেন রিক রসো।
শুক্রবারের বৈঠকে এশিয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে যেমন আলোচনা হয়েছে, তেমনই কথা হয়েছে ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ নিয়েও, এমনটাই জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। আবার প্রতিরক্ষা খাতেও দুই দেশের সহযোগিতা, যৌথ উৎপাদন নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে ভারতের তরফে জানানো হয়েছে।
Leave a Reply